জুমবাংলা ডেস্ক : ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর বাসাবাড়িতে মাথাপিছু পানির চাহিদা নিরূপণ করেছে দৈনিক ১৫০ লিটার। ঢাকার অনেক এলাকার বাসিন্দারা এ চাহিদা অনুযায়ী পানি পাচ্ছে না। অনেক এলাকার বাসিন্দারা আবার এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পানি ব্যবহার করছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার বা অপচয় করছে অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানীর বাসিন্দারা।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) গবেষণা বলছে, অভিজাত গুলশান-বনানী এলাকার বাসিন্দারা পানি ব্যবহার করছে মাথাপিছু দৈনিক গড়ে ৫০০ লিটারের বেশি। অর্থাৎ নির্ধারিত চাহিদার তিন গুণের বেশি পানি ব্যবহার করছে রাজধানীর অভিজাতরা। অন্যদিকে ঢাকার বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের মাথাপিছু পানিপ্রাপ্তি দৈনিক গড়ে ৮৫ লিটার, যা তাদের প্রয়োজনের প্রায় অর্ধেক।
পানি ব্যবহারের দিক থেকে ঢাকাকে নয়টি জোনে ভাগ করে এসব অঞ্চলের ৭৬৮টি পরিবারের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে বিআইজিডি। এর ভিত্তিতে তৈরি গবেষণা প্রতিবেদনটি গতকাল প্রকাশ করেছে তারা।
জোন ১-এ রয়েছে পূর্ব নবাবপুর রোড, বাসাবো-গেণ্ডারিয়া, পূর্ব যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও মানিকনগর। জোনটিতে মাথাপিছু পানি ব্যবহারের পরিমাণ দৈনিক গড়ে ৩৭২ লিটার। জোন ২-এ রয়েছে পশ্চিম নবাবপুর রোড, হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, খিলক্ষেত-আজিমপুর থেকে বুড়িগঙ্গা। এ জোনে মাথাপিছু পানি ব্যবহারের পরিমাণ দৈনিক ২৮৫ লিটার। জোন ৩-এ রয়েছে পূর্ব কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, উত্তর আগারগাঁও রোড ও শ্যামলী, দক্ষিণ খিলক্ষেত ও বেড়িবাঁধ। এ জোনের একজন মানুষ দৈনিক গড়ে ৩০০ লিটার পানি ব্যবহার করে। জোন ৪-এ রয়েছে দক্ষিণ আগারগাঁও, পূর্ব রোকেয়া সরণি, পল্লবী মেইন রোড, পশ্চিম গাবতলী, উত্তর বেড়িবাঁধ ও পল্লবী। এ জোনে জনপ্রতি পানি ব্যবহার হয় দৈনিক গড়ে ২৬৬ লিটার। জোন ৫-এ রয়েছে গুলশান, বনানী, কারওয়ান বাজার, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ ও এয়ারপোর্ট রোড। বিআইজিডির গবেষণায় জনপ্রতি সবচেয়ে বেশি পানি ব্যবহার হয় এ জোনটিতে, দৈনিক গড়ে ৫০৯ লিটার।
রাজধানীর বনানীতে ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। পানির অপচয়ের বিষয়টি উদ্বেগের বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় পানির ব্যবহারের সঙ্গে দূষণ ও অপচয় বেড়ে গেছে। এগুলো আমাদের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এগুলো অবশ্যই আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য শিল্পায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এটিই পানিদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পানির চাহিদাও বাড়বে। কিন্তু এ চাহিদা আমরা কীভাবে বা কতটুকু মেটাতে পারব, সেটিই দেখার বিষয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রাত্যহিক চাহিদা মেটাতে একজন মানুষের দৈনিক ৫০ থেকে ১০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। আর ঢাকা ওয়াসা চাহিদা নিরূপণ করেছে ১৫০ লিটার। যদিও ব্যবহার হচ্ছে দৈনিক গড়ে ৩১০ লিটার। অর্থাৎ চাহিদার সমপরিমাণ পানি অপচয় হচ্ছে।
বিআইজিডির গবেষণা অনুযায়ী, জোন ৬-এর অন্তর্ভুক্ত উত্তর বাংলামোটর, মগবাজার, রামপুরা, বনশ্রী, দক্ষিণ স্টেডিয়াম, পূর্ব নন্দীপাড়া, পশ্চিম পরিবাগ ও বাংলামোটরে মাথাপিছু পানি ব্যবহার হচ্ছে দৈনিক গড়ে ৩৬০ লিটার। জোন ৭-এর অন্তর্ভুক্ত উত্তর জোয়ারসাহারা, কুড়িল, কুড়াতলী, দক্ষিণ রামপুরা ব্রিজ, পূর্ব বাড্ডা, পশ্চিম বারিধারায় মাথাপিছু পানি ব্যবহারের পরিমাণ দৈনিক গড়ে ২১৫ লিটার। জোন ৮-এ রয়েছে উত্তর খান, দক্ষিণ খান, নিকুঞ্জ, খিলক্ষেত ও উত্তরা মডেল টাউন। এ জোনে মাথাপিছু পানি ব্যবহারের পরিমাণ ২৯৫ লিটার। জোন ৯-এ রয়েছে পশ্চিম রোকেয়া সরণি ও পল্লবী মেইন রোড, পূর্ব কচুক্ষেত, ক্যান্টনমেন্ট, পূর্ব বিজয় সরণি ও উত্তর মিরপুর সিরামিক। জনপ্রতি দৈনিক গড়ে ২৯৫ লিটার পানি ব্যবহার করছে এ জোনের বাসিন্দারা।
গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার ৬৮ শতাংশ পরিবার নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে। ১৯ শতাংশ পরিবার হয় অনিয়মিত অথবা অপর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে। ১৩ শতাংশ পরিবার একই সঙ্গে অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত পানি পেয়ে থাকে। অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহের কারণে কিছু পরিবারকে ব্যক্তিগত নানা উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। ওয়াসার পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া পরিবারগুলো পানি মজুদ করছে, পানি সরবরাহ থাকার সময় তাদের কাজ শেষ করে ফেলছে, পানির ব্যবহার কমিয়ে ফেলছে, প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পানি সংগ্রহ করছে, আত্মীয়র বাড়ি গিয়ে পানির প্রয়োজন মেটাচ্ছে ও পানি কিনে ব্যবহার করছে।
গবেষণায় আরো দেখা যায়, মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পানির ব্যবহার বাড়ছে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেও বাড়ছে পানির ব্যবহার। ঢাকায় পানির চাহিদা খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে। এর বিপরীতে ঢাকার পানির উৎসগুলো ক্রমে সীমিত হয়ে আসছে। অনিয়ন্ত্রিত গভীর নলকূপ ব্যবহারের কারণে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এরই মধ্যে বিপত্সীমা ছাড়িয়ে গেছে। একই সঙ্গে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ে বাড়ছে দূষণ। এসবের কারণে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকায় দেখা দেবে ভয়াবহ পানি সংকট।
পানি অপচয় নিয়ে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। অপচয় রোধে ব্যবহার অনুযায়ী পানির বিল ধার্য করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ওয়াসার পানির মান নিয়ে অসন্তোষের বিষয়টিও উঠে এসেছে গবেষণায়। এতে দেখানো হয়েছে, ঢাকার মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ২৭ শতাংশ ওয়াসার পানির মান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। একই সঙ্গে বস্তি এলাকায় বসবাসরত ৩৫ শতাংশ মানুষ এ নিয়ে অসন্তুষ্ট। ২৭ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তারা স্বচ্ছ পানি পাচ্ছে না। ৪৯ শতাংশ জানিয়েছে, তারা কিছুমাত্রায় ময়লা পানি পাচ্ছে। এক-তৃতীয়াংশ পরিবার জানিয়েছে তারা মাঝে মধ্যে নিয়মিত লালচে বা হলদে পানি পাচ্ছে। ভালো মানের পানিতে কোনো সুনির্দিষ্ট স্বাদ না থাকলেও প্রায় ৫৬ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তারা পানিতে নির্দিষ্ট স্বাদ পেয়েছে।
ঢাকার পানিদূষণের পেছনে ওয়াসার দায় থাকলেও, এর পেছনেও নাগরিকদের নানা ভূমিকা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, মাটির নিচের ও ছাদের ট্যাংকি নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণেও ঢাকার পানির মান খারাপ হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকাবাসীকে অবশ্যই সচেতন হতে ও পদক্ষেপ নিতে হবে।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ২০১০ সালে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২০২১ সালের মধ্যে ঢাকাবাসীর জন্য পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও জনবান্ধব পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হবে। কিন্তু অর্থ, প্রযুক্তি ও পরিবেশগত নানা সংকটের কারণে সে লক্ষ্য বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে এরই মধ্যে ওয়াটার মাস্টারপ্ল্যান ও সুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি বিপত্সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ও ঢাকার আশপাশের নদীগুলো দূষিত হয়ে পড়ায় ঢাকা ওয়াসা মেঘনা নদী থেকে পানি আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এদিকে মেঘনাকে ঘিরে ব্যাপক শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে। এ অবস্থায় মেঘনা থেকে কতদিন নিরাপদ পানি আনা যাবে, এটি একটি প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মানেও উত্তীর্ণ হতে পারেনি ওয়াসার পানি। পানির মান পরীক্ষা করতে ঢাকা ওয়াসার আওতাভুক্ত পাঁচটি জোন থেকে ১৫টি পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা যায়, এসব পানিতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান। ১৫টির মধ্যে নয়টি নমুনায় বাংলাদেশ সরকার ও ডব্লিউএইচওর নির্দেশিত মাত্রার চেয়ে বেশি ফেসাল কলিফর্ম ও টোটাল কলিফর্মের উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে একটি নমুনায় দুই ধরনের কলিফর্মই পাওয়া গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।