গাজীপুর প্রতিনিধি: গাজীপুরের শ্রীপুরে ১৯ দিন বয়সী শিশুকে পানিতে চুবিয়ে হত্যার রহস্য এখনও উদঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ বলছে, হয় শিশুর বাবা, না হয় শিশুটির নানা-নানি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশের সন্দেহ শিশুটির মাকে ঘিরেও।
গত রোববার ভোরে শ্রীপুর পৌর এলাকার ভাংনাহাটি গ্রামে ১৮ দিন বয়সী শিশু সন্তানকে বাথ রুমে বালতির পানিতে চুবিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তার বাবার বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত বাবার নাম বিজয় হাসান (২০)। তিনি শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের নগর হাওলা গ্রামের শামসুল হকের ছেলে।
এদিকে নিহত শিশুর দাদা শামসুল হক ফকিরের দাবি, বাড়িতে ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়েছে বলে তার ছেলেকে ফোন করে ডেকে নেয়া হয়েছিল। এরপর পরিকল্পিতভাবে নাতিকে হত্যা করে তার নিরীহ ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে তারা।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার বিজয় হাসান ফকিরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ গতকাল সোমবার আদালতে সাতদিনের রিমান্ড চেয়েছে। সোমবার রাত পর্যন্ত নিহত শিশুর মা, নানা-নানিকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বিকেলে গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ওই সময় প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি।
পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মস্পর্শী। হত্যাকাণ্ডটি খুবই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আমরা নিহত শিশুটির মাসহ তার নানা-নানিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এর রহস্য উদঘাটিত হবেই।
১৮ দিন বয়সী শিশুকে নিয়ে রাতে একই বিছানায় ঘুমিয়েছিলেন শিশুটির মা ও নানি। সকালে শিশুটির মরদেহ পাওয়া যায় গোসলখানায় বালতির ভেতর। শ্রীপুর পৌর এলাকার ভাংনাহাটি গ্রামের এ হত্যাকাণ্ডটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। রাতে পাশের কক্ষেই ঘুমিয়েছিলেন শিশুটির বাবা। মরদেহ উদ্ধারের পর নিহত শিশুর মা, নানা-নানি অভিযোগ করছেন- ঘুমন্ত শিশুটিকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেছেন শিশুটির বাবা। ঘটনার পর তারা নিহত শিশুর বাবা বিজয় হাসান ফকিরকে পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
তবে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বিজয় হাসান বারবারই বলছেন, তিনি হত্যা করেননি। এটা ষড়যন্ত্র। পুলিশ তদন্ত করলেই প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়বে। তাকে ফাঁসানোর জন্য নিষ্পাপ শিশুছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
বিজয় হাসান ফকিরের বাবা শামসুল হক ফকির জানান, গত শুক্রবার রাতে তার ছেলে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। পরদিনই বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু বিকেলেই বিজয় হাসানের স্ত্রী নুসরাত জাহান মুন্নী ফোন দিয়ে তাকে (বিজয়) রাতে যেতে বলে। জরুরি কাজ থাকায় বিজয় যেতে পারবে না জানালে তার স্ত্রী বলে, ‘তোমার জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। তাই মা-বাবা চাচ্ছেন তুমি আসো’।
তিনি আরও জানান, ওই সময় তার ছেলের হাতে কোনো টাকা ছিল না। তাই তার মেজো ছেলে হৃদয় ফকিরের কাছ থেকে ৫০০ টাকা চেয়ে নেয় বিজয়। ওই সময় হৃদয় মোটরসাইকেলে তেল তুলতে আরও ১০০ টাকা দিয়েছিল। ওই টাকা দিয়ে শিশু ছেলের জন্য খেলনা ও ডায়পার কিনে বিজয় হাসান শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। পরদিন সকালেই তার নাতি খুন হওয়ার ঘটনা শুনেন তিনি। আর ওই হত্যাকাণ্ড তার নিরীহ ছেলেকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র চলছে।
শামসুল হক অভিযোগ করেন, হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত। বিজয় হাসানের শ্বশুর-শাশুড়ি মিলে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তার ছেলেকে ফাঁসাচ্ছেন। তিনি পুলিশের কাছে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছেন।
শামসুল হক আরও জানান, ২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ২০ লাখ টাকা দেনমোহরে তার ছেলের সঙ্গে নুসরাত জাহান মুন্নীর বিয়ে হয়। বিয়ের সময় সাড়ে পাঁচ ভরি স্বর্ণালঙ্কার দেয়া হয় মুন্নীকে। এছাড়া প্রায় ৭ থেকে ৮ মাস আগে মুন্নীর বাবা মোফাজ্জল হোসেন বোনের (পৈতৃকসূত্রে পাওয়া) জমি কেনার জন্য তার কাছ থেকে দুই দফা নগদ সাড়ে ১০ লাখ টাকা ধার নিয়েছেন।
শামসুল হক দাবি করেন, টাকা আত্মসাতের জন্যই এমন ভয়ঙ্কর নাটক সাজিয়েছেন মোফাজ্জল।
বিজয় হাসানের মা মলিনা বেগম বলেন, বিজয় এলাকায় ভদ্রভাবে চলাফেরা করে, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন। সে নিজের সন্তানকে হত্যা করতে পারে না। এই ঘটনায় অনেক বড় ষড়যন্ত্র লুকিয়ে থাকতে পারে।
কী ধরনের ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রশাসন সুষ্ঠু তদন্ত করলে সঠিক ঘটনা বের হয়ে আসবে। আমার ছেলেকে মাদকাসক্ত বলে প্রচার করা হচ্ছে কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, আমার ছেলে কখনো একটি সিগারেট পর্যন্ত খায়নি।
এর আগে মুন্নীর মা নাজমা আক্তার দাবি করেছিলেন, বিয়ের কয়েক মাস যেতেই বিজয় হাসান মোটা অঙ্কের যৌতুক দাবি করে। তারা কয়েক দফা বিজয়কে টাকা দিয়েছেন। দুই লাখ টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেলও কিনে দিয়েছেন। এরপরও কয়েক মাস আগে ব্যবসার জন্য ১০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছিল বিজয় হাসান। টাকা না দিলে মুন্নীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল বিজয়। এ ঘটনায় নুসরাত জাহান মুন্নী গত ১৪ আগস্ট শ্রীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছিল।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে শামসুল হক ফকির বলেন, আমরা কিছুই জানতাম না। দুই পরিবারের মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। এখন বুঝতে পারছি মুন্নীর মা-বাবা অনেক আগে থেকেই এসব ষড়যন্ত্র করে আসছিল।
এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শ্রীপুর থানা পুলিশের ওসি (তদন্ত) আক্তারুজ্জামান জানান, হয় নিহত শিশুর বাবা, না-হয় নানা-নানি হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। সন্দেহের মধ্যে রয়েছে নিহত শিশুর মাও। চারজনকে ঘিরেই তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোমবার দুপুরে বিজয় হাসানের সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আদালতে তা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া তিন দফা নিহত শিশুর মা, নানা ও নানিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
আক্তারুজ্জামান আরও জানান, তিনি ছাড়াও পুলিশের একাধিক দল হত্যাকাণ্ডটির ছায়া তদন্ত করছে।
হত্যাকাণ্ডের ছায়া তদন্ত করা শ্রীপুর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শহিদুল ইসলাম মোল্লা জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে ওই বাড়িতে যান তিনি। ওই সময় গোসলখানায় ওই বালতির ভেতর ছোট একটি কাঁথাও দেখেন। ওই কাঁথায় মুড়িয়ে শিশু আবদুল্লাহ আল মাহাদীকে বালতির ভেতর পানির মধ্যে চুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বালতিসহ কাঁথাটি জব্দ করে তিনি নিহত শিশুর মা ও নানিকে প্রায় ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
এসআই শহিদুল ইসলাম মোল্লা দাবি করেন, অনেক সময় নিয়ে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। এর আলামতও পাওয়া গেছে।
শ্রীপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. লিয়াকত আলী বলেন, বাড়িটির বারান্দায় সিসি ক্যামেরা ছিল। তা উদ্ধার করে ফুটেজ দেখা হচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।